অগ্নিযুগের চট্টলায়, অগ্নিপুরুষ...

"কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ন বাহু ও ততোধিক শীর্ন পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে - তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?"

কথাগুলো বলছিলেন মাস্টার দা সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহ।

মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষে ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ শুক্রবার রাত ৮টা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দীর্ঘকালের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করেন মাস্টার দা। বিপ্লবীদের চারটা দল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ইতিহাসের অক্ষয়ী নক্ষত্র হতে। পরিকল্পনা মতো দখলে নিয়ে তারপর দিন বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি তার ঘোষণায় বলেন...

"The great task of revolution in India has fallen on the Indian Republican Army. We in Chittagong have the honour to achieve this patriotic task of revolution for fulfilling the aspiration and urge of our nation. It is a matter of great glory that today our forces have seized the strongholds of Government in Chittagong…The oppressive foreign Government has closed to exist. The National Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood"

চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরুপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। তাকে ধরতে একের পর এক অভিযান চালায় ব্রিটিশরা। শেষ পর্যন্ত পটিয়ার গৈড়লা থেকে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তারা।

কনডেম্‌ড সেলে সূর্য সেনকে রাখা হতো কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরীতে। একজন কয়েদি মেথর সূর্য সেনের লেখা চিঠি ময়লার টুকরিতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতো। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। তিনি স্মরণ করেন তার স্বপ্নের কথা--স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন যার জন্য জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত তিনি ছুটেছেন। তার ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো”।

শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তার একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ, এই বিনোদ, দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন”। বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন।

১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর হবার কথা উল্লেখ করা হয়। সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুড়ী দিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে দেয় এবং তার হাড়ও ভেঙ্গে দেয়। হাতুড়ী দিয়ে নির্মম ভাবে পিটিয়ে অত্যাচার করা হয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। নিষ্ঠুরভাবে তাদের অর্ধমৃতদেহ দুটি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি। চট্টলার এই সূর্য সন্তানদের মৃত দেহকেও এতোটা ভয় পেয়েছিলো ব্রিটিশরা যে ফাঁসীর পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।

এর আগে উপ-মহাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বারুদের স্ফুরণে ব্রিটিশের সাম্রাজ্য কখনো এভাবে জ্বলতে দেখা যায়নি। সে বিদ্রোহের হলকায় দোলা লেগেছিলো পুরো ভারত জুড়েই।

বিপ্লবীর এই মহাপ্রয়াণ দিবসে পূর্বাঞ্চলের পক্ষ থেকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

Post a Comment

0 Comments