ফকির লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে চলছে তিনদিন ব্যাপী লালন উৎসব। বাউল সম্রাট হিসেবে খ্যাত হলেও লালন কি আসলে আধ্যাত্মিক বাউল, নাকি আধ্যাত্মিক ফকির সে ব্যাপারে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তার গানগুলোতে সে নিজেকে যদিও "ফকির লালন" বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু তার জীবন যাত্রায় বাউলের ছাপ পরিলক্ষিত হয়।
আমৃত্যু মানবতাকেই সবার উপরে রেখেছিলেন ফকির লালন। তাইতো গান্ধীরও ২৫ বছর আগে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত 'হিতকরী'তে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম ছিলো রাইচরণ।
তৎকালীন ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফকির লালন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্রষ্টাকে অনুসন্ধান করার যে প্রচেষ্টা করেছিলেন তা খুব সহজ ছিলো না। এই লড়াইয়ে তার হাতিয়ার ছিলো গান। এই গান দিয়েই তিনি জবাব দিতেন প্রতিটি ভুল ব্যাখ্যার, ভুল সত্তার। তিনি যেমন বলছেন...
"মাটির পুতুল গড়ে নাচায়
আপনি মারে আপনি বাঁচায়
তাই জেনে স্বয়ং হতে চায়
লালন কয় তার সকল মিছে।"
আবার তিনিই অন্যদিকে, অন্যদের কাছে জানতে চেয়েছেন...
"পৃথিবী গোলাকার শুনি
অহর্নিশি ঘোরে আপনি
তাইতে হয় দিন রজনী
জ্ঞানী গুনী তাই মানে।।
কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা দেখায় আসমানে।"
এই সকল কথায়, জিজ্ঞাসায় তার উপর যেমন আঘাত এসেছে, এসেছে অপবাদও। তারপরও অহিংস এক প্রেমময় পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর লালন কখনো থেমে যাননি।
তার লড়াই যে সবসময় ধর্মীয় কুসংস্কার, কিংবা আচার-অনাচার নিয়ে হয়েছে তা কিন্তু নয়। মানুষে মানুষে প্রেম ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষেও তাকে দেখা গেছে।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাথে লালনের গভীর সম্পর্ক ছিলো তা অনেকেরই জানা। উনিশ শতকের শিক্ষিত সমাজে তাঁর প্রচার ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে বড় ভূমিকা রাখেন ঠাকুর পরিবারেরই।
কিন্তু এই ঠাকুরদের সঙ্গে লালনের একবার সংঘর্ষ ঘটে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুষ্টিয়ার কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ মজুমদার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এরই একটি সংখ্যায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা বিষয়টির তদন্তে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে আসেন।
এতে করে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের উপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঠাকুর-জমিদারেরা। তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে শিষ্যদের নিয়ে লালন সশস্ত্রভাবে জমিদারের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করেন এবং লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যায়। এর পর থেকে কাঙাল হরিনাথকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করেছেন লালন।
"মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি" বলা মানবধর্ম প্রচারকারী এই আধ্যাত্মিক সাধক বাংলা ১২৯৭ সালের পহেলা কার্তিক দেহধাম ত্যাগ করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর কুমারখালির ছেঁউড়িয়ায় কালিগঙ্গা নদীর তীরে পালিত হয়ে আসছে লালন তিরোধান দিবস।
0 Comments