কৈশোরে হুমায়ুন আহমেদ মানে বাইরে যাওয়া বন্ধ ঘুরাঘুরি বাদ আগে গল্প শেষ করতে হবে। তার গল্পগুলোর মধ্যেই যখন অন্য কোন লেখকের কথা কিংবা কবিতা এসেছে সে লেখকের সম্পর্কেও আগ্রহ জেগেছে। আর সেই আগ্রহ মেটাতে গিয়েই পরিচিত হয়েছি বাংলা সাহিত্যের সাথে, অভ্যেস হয়েছে বই পড়ার।
তার বাবা ছিলেন সার্কেল অফিসার সেই সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকেছিলেন তার পরিবার। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকাকালে হুমায়ুন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু। বান্দরবানে এখনো তার স্মৃতি বিজড়িত স্থান 'নন্দিত নিবাস' দাঁড়িয়ে আছে তার স্মৃতি বহন করে। বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষ হুমায়ুন আহমেদের জীবনও বাদশা হুমায়ুনের জীবনের মতো বহু ট্রাজেডিতে ছিলো পরিপূর্ণ। তার সন্তান নুহাশ পিতার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত চিঠিটি পৌছাতে পারেননি তার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন হুমায়ুন আহমেদ। পিতার কাছে পৌঁছাতে না পারা সে কথা গুলো ব্যক্ত করেছিলেন ফেইসবুক পাতায়। পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম সেটি।
বাবা,
আশা করি তুমি ভালো বোধ করছ। আমার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, টাইফয়েড হবার কারণে পাকস্থলী বেশ ভোগাচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে প্রায় কিছু না খেয়ে কাটিয়েছি, অন্যদিকে জাউ নামের এক অখাদ্য বিছানায় শুয়ে খেতে খেতে সেই ভালো খাবারের কথা ভাবছি যা সুস্থ হলে খেতে পারব। এরমধ্যে একবার গলদা চিংড়ি খাবার শখ হয়েছিল, সেই থেকে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল।
মা ও তোমার বিচ্ছেদ হবার পর আমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল, সব সময় আশায় আশায় ছিলাম তুমি আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হবার পর বুঝলাম দরজা চির জীবনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। রসায়নের পরিভাষায় যাকে বলে- আগুন জ্বলে উঠা, সেটি প্রত্যক্ষ করলাম। তখন আমার ভয় হয়েছিল তোমার সাথে আমার দূরত্ব বাড়বে এবং তুমি আমাকে তোমার ছেলে হিসেবে দেখবে না।
বিচ্ছেদের কয়েকদিন পর তুমি আমাকে ফোন করলে। ফোনে বললে যে সেদিন তুমি বাজার থেকে বিশাল বড় বড় কিছু গলদা চিংড়ি কিনে এনেছ আর সেটি রান্না করে আমাকে নিয়ে খেতে চাও তোমার বাসায়। শীতল যুদ্ধের সময় এটা যে সম্ভব না তা আমরা জানতাম। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হলো না।
আধা ঘন্টা পর বাসার ইন্টারকম বেজে উঠলো। দারোয়ান আমাকে জানালো যে- মস্ত বড় এক গলদা চিংড়ি নিয়ে আমার বাবা গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে। বিস্মিত, হতভম্ব আর খানিকটা উত্তেজিত আমি নিচে নামলাম। তুমি বললে, “বাবা, আমি আসলেই এটা তোমার সাথে খেতে চেয়েছি, তবে এই মূহুর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমি তোমাকে এইটুকু নিশ্চয়তা দিচ্ছি- যেভাবেই হোক, আমি সব সময় তোমার পাশে থাকব এবং কোনো একদিন আমরা আবারও একসঙ্গে ভালো খাবার খাব। তবে এখন তোমাকে এটা নিতে হবে।” এই বলে তুমি আমার হাতে জীবন্ত গলদা চিংড়িটি ধরিয়ে দিলে। বড় চোখ আর লিকলিকে লম্বা পা-অলা বিদঘুটে প্রাণীটি আমার মনে আশার আলো জ্বালালো। আশাটা করেছিলাম- পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তুমি সব সময় আমার কাছে থাকার চেষ্টা করবে।
আমার মনে হয় তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। অন্তত আমার যতটুকু করা উচিত ছিল, তাও করতে পারিনি। যখনই তোমাকে আমি ফোন করতাম, সাধারণত তুমি কথা বলার অবস্থায় থাকতে না। আবার যখন কথা বলতাম আমরা, তখন আমি নিজেকে ঠিকমত প্রকাশ করতে পারতাম না। তোমার মতো কথক তো আমি নই।
সার্জারী করার আগে তুমি যখন ঢাকাতে ফিরে আসলে, তোমাকে দেখতে গিয়ে খুব কষ্ট হতো আমার। প্রত্যেকবারই গেটে দাঁড় করাতো দারোয়ান। বাবার সাথে দেখা করার জন্য দারোয়ানের কাছে ছেলের জবাবদিহিতা- এর চাইতে কষ্টকর, অপমানকর কিছু ছিল না আমার কাছে।
কিন্তু এর কোনোটাই ছুতো নয়, সত্যি বলতে তোমার কাছে আরো থাকার দরকার ছিল আমার। আমি সব কিছু বদলাতে চাই। আমি তোমাকে জানাতে চাই যে আমি সত্যিই তোমাকে মিস করি। আমি তোমাকে জানাতে চাই- আমি যেরকমটা চাই, আমার মতো করে তোমাকে না পাওয়ার কষ্ট এখনো আমাকে পোড়ায়। আমার এই চিঠিটা তোমার জন্য গলদা চিংড়ি।
তোমার ছেলে, নুহাশ।
ভালো থাকুন গল্পের জাদুকর....
0 Comments